বজলুর মন -২


বজলু টানটান হয়ে শুয়ে আছে, আজ দুইদিন ধরে তার জ্বর, মাথায় এ নিয়ে তিন বার পানি ঢালা হয়েছে। বজলুর ছোট মেয়ে ঝোনাকি বিছানার পাশে বসে চুকচুক করে কি যেনো খাচ্ছে, মনে হচ্ছে কয়েক ঘন্টা ধরে এই শব্দ হচ্ছে আঁচার হবে হয়তো, নাকি আইসক্রিম, কিন্তু আইসক্রিম কে কিনে দিবে?

মেয়েটা 'কোন' আইসক্রিম , ছাড়া খায় না - ৫০ টাকা দাম, মাসে দুইবার বজলু তার মেয়ে কে এই আইসক্রিম কিনে দেয়, বজলু ভাবে টাকা হলে সে তার মেয়েকে মাসে প্রতিদিন আইসক্রিম কিনে দিবে, এ বছর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হবে ঝোনাকি, গত বছরই ভর্তি করানোর কথা থাকলেও বজলু করায় নি এই তো সেদিন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির রাতে তার এই মেয়ে টি জন্মালো, বজলু তার মেয়ের নাম রাখতে চেয়াছিলো বৃষ্টি কিন্তু কিভাবে যে নাম হয়ে গেলো ঝোনাকি, তা সে জানে না, বাবা হয়ে নিজের মেয়ের নামও রাখতে পারলো না, ভাবতেই মেজাজ বিগরে যাচ্চে, সবাই ডাকে ঝোনাকি নামে, আগে বজলু তার বউ কে ধমক দিতো যে ঝোনাকি নামে কেন ডাকে, ঝড় বৃষ্টির রাতে যেহেতু হয়েছে তাই নাম হবে বৃষ্টি, কিন্তু বজলুর বউ সে কথায় কোন কান দেয় না, খালি হাসে, মুচকি আবার হাহা করে হাসে, হাসার কারণ কি, বজলু তা জানেনা।

সুস্থ হলে এই ব্যপারে একটা ধফারফা করতে হবে, নাম পরের কথা হাসে ক্যান?
তাই জানতে হবে। জ্বর না হলে এখনই শক্ত করে জিজ্ঞেস করা যেতো, দেখতে দেখতে ঝোনাকি আজ বড় হয়ে গেছে, দিন কি তারাতারি কেটে যাচ্ছে, ভাবা যায়!


এভাবে একদিন সে বুড়ো হয়ে যাবে, তারপরই হয়তো জীবন শেষ, তার তো এখনোও অনেক কিছু জানার বাকি আছে, এই সব কিছু কি সে জানতে পারবে নাকি সব জানার আগেই, জীবন বলবে 'চল যাই, ব্যাটা, সময় শেষ' এসব ভাবতেই বুকের ভিতর ছ্যাঁত করে উঠে, মরলে কি হয়??? ছোট বেলায় একবার একবার বাড়ির মসজিদের ইমাম সাহেবকে এই প্রশ্ন করেছিলো, সেই স্মৃতি এখন আর ভাবাতে চায় না বজলু, তার এখন আরো অনেক কিছু ভাবতে হয়।
অনেকক্ষণ ধরে মাথার ভিতরে শুধু মনে হচ্ছে আকরাম খাঁ ঘোরাফেরা করছে, এই তোহ সেদিন আকরাম খাঁ, -ওহ না, তার নাম তোহ করিম খাঁ, আকরাম খাঁ হলো করিম খাঁর পিতা, ওনার নাম কিভাবে মনে আসলো বজলু বুজতেছে না, কি যে হয় সব শুধু তালগোল পাকিয়া যাচ্ছে। আম খেতে খেতে করিম খাঁ কে করা প্রশ্ন - 'বেহেশতে কি আম আছে, স্যার ' এখনো তার চোখে ভাসে।

সেদিন বজলুর প্রশ্ন শুনে করিম খার চোখ গুলো জ্বলজ্বল করছিলো, মনে হচ্ছিলো এই বুঝি দিলো এক থাপ্পড়, বজলু অবশ্যও কাউরে ভয় পায় না তেমন, ভিতরে ভিতরে অনেক সাহস, কিন্তু বাইরে বাইরে ভয় পায় দেখায়। যা মনে প্রশ্ন আশে তাই বলে দেয়। বজলু শুধু ভাবে এই করিম খাঁ কদিন পরেই যে অবসরে যাবে বুড়ো হয়ে গেছে, সে কিনা ঘুষের টাকা পকেটে নিয়ে বলে - উপহারের টাকা , কি সর্বনাশ, সেদিন তো আরেকটু হলে, কেলেংকারিই হয়ে যাচ্ছিলো ভাগ্য ভালো আছরের নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় বাঁচা গেছে, না হয় করিম খাঁ বজলু কে হয়তো থাপ্পড়ই মারতো।
কি পাগলা ব্যাটা, করিম খাঁ হেটে যাওয়ার সময় বজলু পিছন দিক থেকে থাকিয়ে থাকে বাম পা একটু বাঁকা করে হাটে নাকি বয়সের কারণে এমন হয়েছে কে জানে, ডান হাত পকেটে ঢুকিয়ে সাদা টুপি বের করে মাথায় দিয়ে সোজা হেটে যাচ্ছে করিম খাঁ, -বজলু আবাক হয় এই পকেটেই না একটু আগে করিম খাঁ টাকা রেখেছিলো, ঘুষের টাকা, বজলুর অবাক হওয়ার কারণ অবশ্য ভিন্ন, টুপি বের করার সাথে সাথে টাকা গুলো বাহিরে পরে গেলো কিনা, -নাহ এই লোক তো এতো বোকা হওয়ার কথা না।

বজলু ভাবে আর হাসে, জ্বর অবস্থায় বজলুর সেই মুচকি হাসি দেখে বজলুর বউ পাশে বসে কাঁদে, লোকটার কি এমন হইলো, দুইদিনে এই একটু জ্বরেই বিরবির করে কথা বলে, আবার হাসে, বজলুর বউ বুঝে না, জ্বর যে পানিতেও কমতেছে না।



গভীর রাতে বজলুর ঘুম ভেঙে গেছে, কপালে হাত দিয়ে দেখে ঘাম, জ্বর কি তাহলে কমে যাচ্ছে, মুখ তিতা তিতা লাগছে পেটে ক্ষুধা অনুভব হচ্ছে না, জ্বর হলে এক যে রোগা ভাব টা হয় সেটা হচ্চে না, এটা ভালো কথা কিন্তু বুক কাপছে, মনে হচ্ছে বজলু যেনো হাপাচ্ছে। এত কিছু ভাবার পরে বজলু বুঝতে পারে সে একটা ভয়ের সপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠেছে , প্রচন্ড ভয়ের সপ্ন , কিন্তু কিছুতেই পুরো সপ্নটা মনে করতে পারছে না, শুধু চোখের সামনে ভাসছে বজলু একটা খালি মাঠে দৌড়াচ্ছে তার হাতে একটা খালি ব্যাগ, মাঠের সামনে অন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না বিরাট বড় মাঠ, দৌড় থামালেই বজলূ শেষ, কারা যেনো আসছে পিছন থেকে, কিন্তু কারা আসছে কেনো আসছে, কেনই বা এই মাঠে, কোথায় যাচ্ছে তার কিছুই মনে করতে পারছে না।
অবাক করার মতো ব্যপার বুক এখনো কাপছে, এটা তো সপ্ন, সে তো আসলে দৌড়ায়নি তাহলে এমন কেনো হচ্ছে? বজলু উঠে বসে মাথায় হাত দেয় কপালে এখনো ঘাম লেগে আছে, সপ্নের শেষ অংশটা হঠাৎ এখন মনে পড়েছে - বজলু দৌড় থামিয়েছে মনে হয় মাঠের শেষ প্রান্ত, আশে পাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নাই, একি আজব ব্যপার পায়ের কাছে এই তো একজন বসা - সপ্ন কি এমনই হয়!!

পায়ের কাছে যিনি বসা বজলু তাকে চিনতে পেরেছে - তিনি করিম খাঁ বজলুর বহু পরিচিত একজন, পা ভাজ করে বসে আছে, মুখে কোন হাসি নেই - কি বজলু খালি পলিথিন নিয়ে দৌড়াও, কেনো? তোমারে আমি আগেই বলছি তুমি খুব বোকা, খালি আবোল তাবোল প্রশ্ন শিখছো, আর এখন মাইলের পরে মাইল খালি ব্যাগ নিয়ে দৌড়াইয়া আসছো, এখন বুজলা তো তোমার জ্ঞান কেমন? করিম খাঁর মুখ থেকে হুবহু এই কথা গুলোই শুনেছে বজলু। কিন্তু বজলুর ব্যাগ তো খালি না এখন ভারি মনে হচ্ছে, ব্যাগের মধ্যে কি? ব্যাগের মধ্যে যা দেখেছে বজলু, সেটাই বজলুর ভয় পাওয়ার মূল কারণ।

বজলু ব্যাগের ভিতরে তাকিয়ে দেখে একটা কাটা মাথা, কাত হয়ে পরে আছে ব্যাগের মধ্যে দৌরে আসার কারণে পুরো ব্যাগ রক্তে মাখা মাখি হয়ে গেছে কিন্তু সপ্নে এত দৌড়ানোর পরেও কেনো তা বোঝা গেলো না যে, ব্যাগের মধ্যে কিছু আছে, সেটাই বুঝতে পারছে না, বজলু, তার থেকেও বড় কথা হলো ব্যাগে থাকা কাটা মাথাটা তার নিজের, এ কিভাবে সম্ভব, নিজের কাটা মাথা নিজে কিভাবে দেখে, দেখেতে হলে তোহ চোখ লাগে, তাহলে?
সপ্ন কি এমনই হয়, কোন সন্দেহ নাই এটা খারাপ সপ্ন, এই খারাপ সপ্নের মানে কি, খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে সামনে এমন কিছু, নাকি করিম খাঁর কথাই ঠিক!!


বজলুর মন খারাপ হয়ে গেলো, সে তো অফিসে কোন ঘুষ খায় না, কারো সাথে মিথ্যা বলে না, তেমন কোন খারাপ কাজ ও সজ্ঞানে করে না, তাহলে তার সাথে কেনো খারাপ কিছু ঘটবে, কেনো সে এই রকম সপ্ন সে দেখবে, তাই যদি হয়, তাহলে খুব জানতে ইচ্ছে হয় ঠিক এই রাতে করিম খাঁ কি সপ্ন দেখেছে। সেও কি দৌড়া দৌড়ির কোন সপ্ন দেখছে, তার সপ্নে কি ভয় পাওয়ার মতো কেউ এসেছিলো, নাকি সেই ওই একই রকমের হেটে যাচ্ছে ডান হাত পকেটে ঢুকিয়ে যে পকেটে সে টাকা ও টুপি এক সাথে রাখে।

সপ্ন পরবর্তী ভাবনায় বজলু এতোটাই মগ্ন ছিলো যে, সে তার জ্বর এর কথা ভুলেই গেছে, আসলে তার জ্বর কমেনি, এক্টুও কমেনি, এখন আবার ভিমরি দিয়ে কাপুনি উঠতেছে। তাহলে এই জ্বর এতক্ষন কোথায় ছিলো, ব্রেইন জ্বর এর কথা ভাবতেই আবার এমন হলো, তাহলে সব কিছু এই ব্রেইনই করে, আবার আরেক ভাবনা এসে বজলু কে গ্রাস করে, জ্বর আসুক-জ্বর সেরে যাবে, বজলু শুধু ভয় পাচ্ছে সে আবার এই রকম কোন সপ্ন দেখবে নাতো ...!