বজলু করিম খা’র রুমের ভিতরে চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার পা থরথর করে কাঁপছে, দুই হাতে দুইটা টাকার বান্ডিল, হা পা কাঁপার কারণ হলো,
এই টাকা গুলো তার না, এইগুলো করিম খাঁর টাকা।
খুব সম্ভবত ঘুষের টাকা। সে নিশ্চিত না, করিম খাঁ মাত্র বের হলো নামাজের জন্য, নামাজ, দুপুরের খাবার, রেস্ট এর পরে হয়তো ফিরবে, কিন্তু এই গুলো তার হাতে ধরিয়ে দেয়ার কারণ কি?? তা বজলু জানে না।
রুমের ভিতরে কোন একটা জায়গায় একটা লোহার সিন্দুক আছে, আসলে লোহার নাকি অন্য কোন ধাতব দিয়ে তৈরি তা বলা কঠিন, অফিসের সাকু ভাই, যিনি করিম খাঁর খুব কাছের মানুষ ওই দিন বলছিলো এই সিন্দুক নাকি বুলেট প্রুফ। তার এক মামা আছে যিনি পুলিশের এক বিরাট অফিসার, যিনি নিজে নাকি 'গুলি করে টেস্ট করে দেখেছে। পাচ রাউন্ড গুলি করার পরও সিন্দুক নাকি বহাল তাবিয়তে ছিলো, তার কিছুই হয়নি।
ব্যাপারটা বজলুর কাছে আজগুবি লাগে, রুমের ভিতরের সিন্দুক কেনো?? আর এই সিন্দুক কেনো বুলেট প্রুফ হতে হবে?? এর আসলে কাজ কি। আর এই রকম সিন্দুক কেনো একজন পুলিশ অফিসার গুলি করে চেক করবে, তার কি আর কাজ নাই।বজলুর মাথায় ঢুকে না। যাই হোক যেই লোক করিম খাঁর টাকা বলে বজলুর হাতে এই টাকা গুলো ধরিয়ে দিয়ে গেছে তাকে আর আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না।
লোক টা কি উধাও হয়ে গেলো নাকি?
করিম খাঁ খুব ভালো করেই জানে, বজলু আর যাই করুক টাকা মেরে বা ভেগে যাওয়ার লোক না, সম্ভবত এই কারণেই কোন ভাবে বজলুর হাতে টাকাটা ধরিয়ে দিয়ে করিম খাঁ নিশ্চিন্তে দুপুরের বিরতিতে গেছেন। আর যিনি টাকা টা এনেছেন তিনিও কোন না কোন ভাবে এটা জানেন, নিশ্চয়ই!!
বজলু মহা বিপদে, সে এখন “কোথায় যাই কোথায় রাখি” এরকম অবস্থায়। এরকম বান্ডিল থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট নিয়ে নিলে কি এমন ক্ষতি?? কেউ জানবে না, এই সব টাকা পয়সা এতো গোনাগুনি করে লেনদেন হয় না।
কি এক ভয়ংকর অদ্ভুত ব্যাপার এই সকল বিষয়ে চোরেরা, বাটপারেরা, ঘুষ খোরেরা খুব সৎ তারা এক জন আরেক জনকে কোন ভাবেই ঠকায় না। এমকি মিথ্যা ও বলে না। শুধু তাই না বেশ রকমের হেল্পফুল ও বটে। এই লাইনে সব কিছুই হলো বিশ্বাস। এই বিশ্বাস না থাকলে আপনি এই লাইনে কাজ করতে পারবেন না।
ওই লোক নতুন কোন কাজের ব্যাপারে করিম খাঁ ‘র সাথে কথা হচ্ছিলো, করিম খাঁর বয়স এখন ৬০ এর বেশি আর দুই / তিন বছর, এর পরেই অবসর। তাই তার অভিজ্ঞতা থাকে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা লোককে ভরসা দিচ্ছিলো। কাজ হয়েছিলো কিনা, বজলু তা জানে না।
বছর হলো হজ্জ করে এসেছে করিম খাঁ, কিছুদিন আগে তার গ্রামে এক মাহফিলের অনুষ্ঠানে তার নামের আগে আলহাজ্জ লিখে দিয়েছিলো এ নিয়ে করিম খাঁ মাহফিল কমিটির সাথে বেশ রাগারাগিও করেছিলো, এসব নাম নাকি তার ভালো লাগে না, হজ্জ করেছে শুধু আল্লাহ্র জন্য, এসব লোক দেখানো বা নাম দেখানোর জন্য না।
সেদিনের সেই বিকেল বেলা বজলু’র খুব ভালো করে এখনো মনে আছে –
করিম খাঁ’র সামনের ঘুনে খাওয়া কাঠের চেয়ারে এক মওলানা সাহেব বসা, লাল লম্বা দাড়ি, ধূসর পাঞ্জাবী, সাদা পাগড়ী। তিনি করিম খাঁর গ্রাম এলাকা থেকে এসেছেন। আগামী শুক্রবার বাদ জুম্মা থেকে বাৎসরিক মাহফিল শুরু হবে চলবে টানা তিন দিন পর্যন্ত। বিশেষ বক্তা হিসেবে থাকবেন বিশিষ্ট “মুফতি রহিমুল আজাদ হক্কধারি”, তার ডিমান্ড এখন পার নাইট লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, তাকে নিয়ে আসা মানে বিরাট ব্যাপার স্যাপার। মাওলানা সাহেব এই কথা গুলোই এক এক করে করিম খাঁ কে বলছিলেন।
করিম খাঁর কাছে এই মাওলানা সাহেবের আসার কারণ অবশ্য আর্থিক সহোযোগিতা। করিম খাঁ তার সিন্দুক থেকে এক বান্ডিল টাকা মাওলানা সাহেব কে দিলেন আয়োজনের এক বিশেষ দাতা বলে কথা। টাকা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে , মাওলানা সাহেব যেন ঘোষণাই করলেন – “ মায়ের পেট হতে বাচ্ছা জন্ম নিলে যেমন নিষ্পাপ, নিষ্পাপ ( দুই বার বললেন ) থাকে, আপনি হলেন এখন তাই।” এই কথা বলার সরাসরি কারণ অবশ্য এই টাকা দেয়া না, করিম খাঁ একটু আগে তার হজ্জ করে আসার কথা বলছিলেন। আর হজ্জ থেকে এলে কোন পাপ থকার কথা না।
মাওলানা সাহেব যাওয়ার আগে দুই মিনিটের মোনাজাতে তিনি বার বার বলছিলেন – “হে, মহান আল্লাহ্, আপনি আমাদের সৎ পথে উপার্জনের তৌফিক দান করুন।” আল্লাহ্ এই তৌফিক দানের দোয়া সম্ভবত কবুল করেন নাই। আজ তিন মাসে বেশি সময় পার হয়ে গেছে ওই ঘটানার পরে।
পাক্কা ২ ঘন্টা পরে করিম খাঁ ফিরেছে, বজলু কিছু বলে না। সে টাকা গুলো দিয়ে, নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো।
লিফটের সামনে যে ছেলেটা বসা সে লিফট ম্যান হিসেবে জয়েন করেছে ছয় মাস হলো নাম – ‘মোঃ হাসান তালুকদার’ বজলু তাকেও খুব ভালো করে চিনে আর এই নাম টাও এই অফিসের অন্য কেউ জানে না, শুধু বজলু জানে। কিন্তু, সবাই তাকে ফারুক হোসেন নামে চিনে। ফারুক ভাই, ফারুক ভাই বলে ডাকে, বেশ সম্মান করে।
অথচ, এক বছর আগে যখন লিফট ম্যান নিয়োগ হয়েছিলো সেখানে চূড়ান্তভাবে এই লিফটের জন্য যিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি হলেন মোঃ ফারুক হোসেন, যোগ্যতা বিএ পাস ।
বজলু জানে - ‘মোঃ হাসান তালুকদার’ মূলত এস এস সি পাস, গ্রামে তার ছোট ভাই আর মা আছে। হাসান এর গায়ের রং ফর্সা, চোখ গুলো চিকন চিকন, হুট করে দেখলে একটু চাকমা মনে হয়, সব সময় শার্ট আর প্যান্ট ইন করে থাকে। জয়েন করার এক মাস পরেই সে চোখে চশমা পরা শুরু করেছে। মাথায় হালকা তেল দিয়ে বাম দিকে সুন্দর করে চুল আচড়ায়। মাঝে মাঝে হাত পিছনে রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। “প্লিজ”, “এক্সকিউজ মি” টাইপ ইংলিশও বলে।
বজলুর যখনই হাসানের সাথে দেখা হয় সে হাসে। দুজনেই হয়তো একই জিনিস জানে। যা এই অফিসের তারা দুই জন ছাড়াও আরো একজন মানুষ জানে।
সবাই চশমা ছাড়া কাঠের চশমা পরে ঘুরছে, এত কিছু দেখছে তবু যেনো কিছু দেখছে না। সকাল সন্ধ্যা এক অবিরাম অভিনয় চলে যায়। যে যত ভালো
অভিনেতা সে তত ভালো চেয়ারে বসে।
বজলু তাদের ভিতরে একটূ বেমানান, তবু সে মাঝে মাঝে সবাই কে বলে লিফট ম্যান ছেলেটা কিন্তু বিএ পাস!!