বজলু হন হন করে হেটে যাচ্ছে তার হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ, সে যাচ্ছে মিহির হকের সাথে দেখা করতে, লোকটার সাথে তার পরিচয় মাত্র দশ
বারো দিনের। সেদিন অফিস থেকে নেমে রিক্সা ভাড়া দেয়ার সময়।
মিহির হক, বিরাট জ্ঞানী মানুষ – দশ দিনের এই পরিচয়ে অনেক জ্ঞানের কথা শুনে ফেলেছে বজলু।
বাজারে এতো কিছু কিনতে পাওয়া যায়, জ্ঞান কেনো কিনতে পাওয়া যায় না এই ভেবে বজলু অস্থির, কথা টা অবশ্য ঐদিন হোটেলে পুরি খেতে খেতে
মিহির হক ই প্রথম বলছিলো, সেদিনের সেই আড্ডার পরই, বজলুর মন মিহির হকের জন্য একটা ভালোলাগা কাজ করে।
- বজলু ভাই, এই যে দেখেন বাজারে এতো কিছু কিনতে পাওয়া, কই কোথাও তো জ্ঞান কিনতে পাওয়া যায় না, যায় বলেন? যায় না।
অনেকে বলে বই পরে জ্ঞান পাওয়া যায়, আসলে ব্যাপার টা পুরোপুরি সত্য না, নির্দিষ্ট বই পড়ে যে জ্ঞান পাওয়া যায় ঐটা হলো “অবজেক্টিভ টাইপ”;
অবজেক্টিভ টাইপের মানে বুঝেন বজলু ভাই?
বজলু মাথা নাড়ে, সে এই কথা এর আগে শুনে নাই,-
এর মানে হলো, যায় বোঝার ধরন যেমন, যার জ্ঞানের রং যেমন । এখানেও সেই জ্ঞানের ব্যাপার, জ্ঞান হইলো ক্ষুধা।
বজলু খুব ভালো করেই জানে তার জ্ঞানের ক্ষুধা অনেক বেশি।
মিহির হক আবার বলে – তবে বেশি জ্ঞানের একটা খারাপ দিক আছে সেটা হলো – “যত জ্ঞান তত যন্ত্রনা”
- এটা আবার কেমন কথা মিহি ভাই, বুঝলাম না তো?
অর্থাৎ আপনি যতো কিছু বোঝা শুরু করবেন, যাতো ভালো ভাবে বুজতে শুরু করবেন, আপনার আশেপাশে দেখে আপানার তত খারাপ লাগবে।
এটা এক বিরাট কষ্ট, উপলব্ধি না হইলে বুজবেন না।
বজলু আবার মাথা নাড়ে আবার ভাবে, ইশ আসলেই যদি জ্ঞান বাজারে কিনতে পাওয়া যেতো, তাইলে সে আজকে ১০০ গ্রাম জ্ঞান কিনে নিয়ে যেতো।
একমাসে দশ বার কিনলে এক কেজি হইত, খারাপ কি। এক কেজি জ্ঞান খাইলে করিম খাঁ র সাথে – ঘুষ খাওয়া ও বেহেশতে আম খাওয়া নিয়া ভালো
তর্ক করা যেতো।
কাচা মরিচের কেজি ২০০ টাকা বজলু যখন কিনে ২৫০ গ্রাম করে কিনে ৫০ টাকা করে। জ্ঞান কিনতে পেলে এর থেকে দাম একটু বেশি হলেও বজলু
প্রতিদিন কিনতো। কারণ, কাচা মরিচের চেয়ে জ্ঞানের ক্ষুধা অনেক বেশি।
মিহির হক এক অদ্ভুত মানুষ, এতো বড় বাসায় একা থাকে, তার মাথায় ঝাকড়া চুল। ঘন কালো, কোঁকড়ানো, ছোট কোন পাখি ভুল করে বাসা বাধতে
পারে চাইলে। চোখে গোল গোল ডিম চশমা। প্রযোজনের থেকেও অনেক বেশি শুকনা! হাটার সময় পরনের প্যান্ট ঢল ঢল করে। সালাম দিলে
বাংলায় উত্তর দেয় “শান্তি চাই আমিও”।
বজলু বিছানার উপরে পা দুলিয়ে বসে আছে, জ্বর সেরে যাওয়ার পরে এই প্রথম সে বাহিরে বের হইছে। দুই দিন আগের স্বপ্ন তার মাথার ভিতরে এখনো ঘুরছে।
বিছানার সামনেই মিহির হকের টেবিল এরকম এলোমেলো টেবিল সে এর আগে দেখে নাই। টেবিলের উপরে একটা ছোট্ট স্টীকারে নোট লেখা
– “শয়তানের সাথে দেখা, জবান বন্ধী নিতে হবে।”
কি ভয়কর!! এই টা কি ধরনের কথা!!
যদিও এই রকম একটা কথা দুই/এক বছর আগে বজলূ করিম খাঁ থেকে শুনেছিলো। করিম নাকি এক দিন আসরের নামাজ পরে ফিরে আসার সময়
একই রাস্তায় এতো বার ঘুরেছে যে সে যখন বাসায় আসে তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছিলো। এইমাঝের সময় সে একই রাস্তায় নাকি ১৯ বার চক্কর দিয়েছে,
তার তার সাথে কেউ একজন ছিলো যে নাকি শুধু উলটাপালটা কথা বলেছে, কথা গুলো মনে করেই করিম খাঁ নাউজুবিল্লা বলে।
মিহির হক বাথরুম থেকে এসে চেয়ারে বসে, বজলু কে দেখেই বলে আপনি কি কিছুদিন আগে ভয়ংকর কোন সপ্ন দেখেছিলেন নাকি?
এতো বড়ো বাসায় সুনসান নীরবতায় এই প্রশ্ন শুনে বজলু তব্দা খায়। যাই হোক বজলু খুব সুন্দর ভাবে এড়িয়ে ছোটো স্টিকারের দিকে তাকিয়ে
প্রস্ন করে – মিহি ভাই আপনি কি শয়তানে বিশ্বাস করেন?
মিহির হক মুচকি হাসে – বজলু ভেবেছিলো মিহির হক হা হা করে জোরে হাসবেন,আসলে তা ঘটলো না।
- বজলু ভাই, আমি আসলে কি বিশ্বাস করি, তাতে এই এতো বড়ো দুনিয়ার বা বিশ্বের বা এই গ্যলাক্সির কিছুই যায় আসে না।
এ ধরনের কোন কিছুর প্রমান এখনো কেই পায় নি। আমি এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। আপনি শুধু একবার চিন্তা করেন, মাটি থেকে
আধা কিলোমিটার উপরে উঠলেই আপনাকে আর ঠিকভাবে দেখা যাবে না। শুধু বেচে থাকাটাই উপভোগ করেন, আর সব কিছু ভূলে যান।
বজলু – মিহির হকের সামনে বিস্কুট দিয়ে চা খেতে খেতে ভাবে এতো অগণিত অদৃশ্য শয়তানের মানুষকে কষ্ট দেয়ার যে এতো প্রানপন চেস্টা,
সেটা কি বৃথা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। মিহির হকের মতো মানুষে কেনো এই পৃথিবী টা ভরে যায় না। সব জায়গায় শুধু করিম খাঁ মতো স্বার্থ বাদী
বাটপারে গিজগিজ করে।
আড্ডা দিতে দিতে এখন প্রায় রাত ১০ টা, বজলু মোবাইল খুলে দেখে, বউএর ১০ টা মেসেজ কিন্তু একই মেসেজ ১০ বার, এই টা কেমন কথা,
একই মেসেজ কেনো ১০ বার দিতে হবে।
হাজার বছর জুড়ে মেয়েদের এই এক অস্থিরতা, যা চলে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজম্নে, বলেছে মিহির হক!
বাসায় ফেরা পথে বজলু দেখে কাছেই একটা জটলা। কারা যেনো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা দেখছে, বেশ চিল্লা পাল্লা, কাছে গিয়ে ই দেখা যায়
একটা বারো বারো তেরো বছরের একটা ছেলেকে দুই দিন জন লোক বেশ মারছে, যেনো জনম জনমের ক্ষোভ জমে ছিলো, যেনো হাজার বছরের শ্ত্রুতা,
তা না হলে এভাবে কেউ মারে। বজলু কাছে গিয়ে জানতে পারে ছেলে টা একটা বড় রুটির প্যাকেট নিয়ে দৌড় দিয়েছিলো এক বীর পালোয়ান তাকে দৌড়ে
ধরে ফেলেছে। তাই এখন কঠিন বিচার হচ্ছে, সবাই মিলে এই বিচার করছে।
বজলু জটলা থেকে বেড়িয়ে বাসার দিকে হাটছে, মনটা খুব খারাপ, এইবয়সে এই ছেলেটার স্কুলে থাকার কথা, সে এই রুটির প্যাকেট কেনো দৌড় দিলো,
চুরির নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।
পরম শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তার ঠিক কোন খেলায় এই ছেলেটা আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে, মার খাচ্ছে তা ভেবেই বজলুর চোখে জল চলে আসে।
রুটি চুরির শাস্তি যদি এটা হয় তবে, করিম খাঁর মতো যারা পুকুর চুরি করে খাচ্ছে তাদের কি হবে?
বজলু ভাবে জনতার বিচার একদিন হবে, হ্যাঁ হবেই হবে।
“বজলু ভাই আসলে সঠিক বিচার পেতে হলে বা করতে হলে, যা লাগে, টা হলো, অনেক বড়ো হাত, যেই হাত দিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে ২০ তলা
পর্যন্ত ছোয়া যায়, যে হাত নরম জায়গার আদর করতে পারে, আবার যেই হাত শক্ত জায়গায় ঘুষি মারতে পারে, যেই হাত কবিতা লেখে না,
কবিদের বেতন দেয়, যেই হাত বিদ্রোহী বাচালের মুখে একবস্তা টাকা ছুড়ে দেয়, সেই রকম হাত লাগে, সাধারন ভালো মানুষের হাত খুব ছোট,
এই রকম হাত কোনো বিচার করতে পারে না, এমনকি নিজের পিটও ঠিক মতো চুলকাতে পারে না……।”
আজ-ই রাতের আড্ডায় কথাগুলো বলছিলো মিহির হক। কি আশ্চর্য আসলেই কি তাই।
বজলু ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, কিন্তু তার তো এক কেজি পিয়াজ আর দুই কেজি আলু নিয়ে আসার কথা ছিলো…!